Social Icons

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

বাংলাদেশে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর জীবনমান: একটি উপেক্ষিত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর জীবনমান: একটি উপেক্ষিত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেশজুড়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বসবাস করলেও উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী, যাদের অধিকাংশই "বিহারী" নামে পরিচিত, তারা আজও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নাগরিক অধিকার থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত। এ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে শহরে বস্তি ও তথাকথিত "বিহারী ক্যাম্পে" বসবাস করছে। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে, যেটা আমাদের জাতীয় বিবেককে নাড়া দেয়ার মতো।

ইতিহাস ও পটভূমি:
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় এদের অনেকেই পাকিস্তানে চলে আসে এবং পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনিরাপদ অবস্থায় পড়ে যায়। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় তারা রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হয়।

আজও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন মিরপুর, মোহাম্মদপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, সৈয়দপুর, রাজশাহী ও রংপুরসহ ১১৬ টিরও বেশি ক্যাম্পে প্রায় ৭ লক্ষাধিক উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী মানবেতর অবস্থায় বসবাস করছে। এদের অধিকাংশ ক্যাম্পে মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব প্রকট। অধিকাংশ স্থানে পানি, বিদ্যুৎ ও পয়ঃনিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা নেই।

উর্দুভাষীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই নিপীড়ন, হুমকি ও সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে। এর একটি নির্মম উদাহরণ বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে  ২০১৪ ইং সালের ঘটে। ঢাকার পল্লবী থানাধীন কুর্মিটোলা ক্যাম্পে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দ্বারা এক উর্দুভাষী পরিবারের ঘরে তালা মেরে আগুন লাগিয়ে ৯ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ছায়া থেকেও তারা বঞ্চিত।

উচ্চশিক্ষা ও ভাল চাকরির সুযোগ থেকে উর্দুভাষীরা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। শিক্ষার অভাবে তাদের প্রজন্ম পর প্রজন্ম দারিদ্র্য ও অশিক্ষায় নিমজ্জিত রয়েছে। যদিও কিছু এনজিও শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছে, তবুও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অনেকেই মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না এবং কর্মসংস্থানের কোনো টেকসই পথ তাদের সামনে থাকে না।

রাজনৈতিক ব্যবহার ও প্রভাব:
বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো এই জনগোষ্ঠীকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ভোটের মৌসুমে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোটের পরে সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ফলে তারা চিরকালই ব্যবহৃত ও বঞ্চিত – দুটো ভূমিকায় বন্দি থেকে গেছে।

সমস্যার গভীরতা ও সামাজিক প্রভাব।
এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেতৃত্বের অভাব, শিক্ষার অভাব এবং চাকুরির অভাব – এই তিনটি দিক সবচেয়ে বেশি প্রকট। তারা মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত এক নিঃসঙ্গ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, হতাশা, মাদকের প্রতি আসক্তি, অপরাধ প্রবণতা এবং আত্মবিশ্বাসহীনতা এই জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎকে আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে।

সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়:
উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিচের কার্যকর পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

1. নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণ:
তাদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, শিক্ষাগত সনদসহ সব নাগরিক সুবিধায় সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

2. ক্যাম্প পুনর্বাসন ও আবাসন ব্যবস্থা:
আধুনিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্যাম্পগুলো পুনর্বাসন করতে হবে। পর্যায়ক্রমে তাদের জন্য স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলা এবং ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করতে হবে।

3. শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন:
শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

4. চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি:
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চাকুরির কোটা বা বিশেষ কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে যাতে তারা আত্মনির্ভরশীল হতে পারে।

5. আইনগত সহায়তা ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ:
যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

6. নেতৃত্ব ও সচেতনতা গড়ে তোলা:
তাদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে, যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের সমস্যার সমাধান চাইবে।

উপসংহার:
উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশেরই নাগরিক। চার প্রজন্ম ধরে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার এই জনগোষ্ঠীর প্রতি জাতি ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। এখনই সময় – রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একসাথে কাজ করে এই জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার। অন্যথায়, আরেকটি প্রজন্ম হারিয়ে যাবে অন্ধকার ভবিষ্যতের গহ্বরে।
স্টাটাস পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। 
আপনার কোনো মতামত থাকলে কমেন্টে লিখে জানাতে পারেন।

𝑀. 𝒮𝒽𝒶 𝐻𝓊𝓈𝓈𝒶𝒾 𝒜𝓃𝓈𝒶𝓇𝒾